দক্ষিণবঙ্গের দানবীর অমৃত লাল দে’র ২৯ তম প্রয়াণ দিবস আজ
জাহিদুল ইসলাম মামুন: দক্ষিণবঙ্গের অন্যতম দানবীর, শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার পাঁচগাঁও গ্রামের কৃতিসন্তান অমৃত লাল দে‘র আজ ২৯তম প্রয়াণ দিবস । ১৯৯৩ সালের ১৪ জুন তিনি দেহ ত্যাগ করন ।
১৯২৪ সালের ২৭ শে জুন তিনি নড়িয়ার পাঁচগাঁও চন্ডিপুরে জন্মগ্রহণ করেন। ক্ষণজন্মা এই মানবপ্রেমিকের জন্য অসীম শ্রদ্ধা। নিচে অমৃত লাল দে’র সংক্ষিপ্ত জীবনী তুলে ধরা হলো। অমৃত লাল দে এই মাটির সন্তান বরিশালের রুপকার ভাবা হয় মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্তকে, মানুষের মুখে রচিত তার দ্বিতীয় নাম কিংবা উত্তরসূরীর নাম অমৃত লাল দে। সাহিত্য কিংবা শিক্ষাঙ্গনে, অন্দর থেকে উপাসনালয়, বরিশালের পথ প্রান্তরে, পতাকায় শুভ্র সাদা কাশফুলের মতো, শিমুলতুলো ফোটা মেঘের মতো মিঠা নদীর কলকল ধ্বনির মতো বেঁচে থাকা মানুষ অমৃত লাল দে।
বরিশালের বিখ্যাত কারিকর বিড়ি, অমৃত ফুড প্রোডাক্টসসহ অসংখ্য ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠান তার সততা মেধা, কঠোর পরিশ্রমে বাংলাদেশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
রাসমোহন দে ও সারদা সুন্দরী দে’র ঘর হয়ে ১৩৩১ বঙ্গাব্দের ১৩ আষাঢ় ও ১৯২৪ খৃষ্টাব্দের ২৭জুনে অমৃত লাল পৃথিবীতে এসেছেন , তার জন্মভূমি শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার পাঁচগাঁও চন্ডিপুরে। সেসময়ের পাঁচগাঁও গ্রামের অনেক কিছুই তিনি তার লেখা ডায়রিতে বর্ণনা করেছেন। অজপাড়া গ্রাম, জীবিকার প্রধান উৎস ছিল যাদের চাষাবাদ, মাছধরা ও ছাতা সেলাই করা আর অমৃত লালের পরিবার করতেন পাটি বুননের কাজ। ছেলেবেলায় অভাব অনটন, খেতে না পারার কষ্ট, পরিবারকে অভুক্ত দেখার কষ্ট, জামাকাপড় পরতে কিংবা স্কুলের না পড়তে পারার কীযে কষ্ট ছিল তাও তিনি যত্ন করে স্মৃতিচারণ করে গেছেন। দারিদ্রতার করাল গ্রাসে জর্জরিত হয়ে আনমনেই তার প্রশ্ন জাগতো কেন আমাদের পরিবার এতো গরীব, কেন দুবেলা দুমুঠো খাবার জোটে না?
এই প্রসঙ্গে অমৃত লাল তার ডায়রিতে লিখেছেন “দু’তিন দিন অনাহারে থাকার পর যখন একটু ভাত জুটতো, তখন কী যে আনন্দ হতো, মনে হতো এতো সুখ বুঝি পৃথিবীতে আর নাই”
পাঁচগাঁও-এর পাঠাশালায় অমৃত লাল দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন, তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার পরে অর্থের অভাবে আর পড়া হয়নি। পড়াশোনার স্মৃতিচারণে তিনি লিখেছেন “সেসময় স্কুলের বেতন চারআনা ছিল, স্কুলে যেতে একটি খাল পার হতে হতো সেজন্য একআনা লাগতো, তাই খাল সাঁতরিয়ে পার হয়ে পরনের ধুতি রোদে শুকিয়ে স্কুলে যেতেন।”
তাদের জায়গাজমি ছিল সামান্য একসময় পদ্মানদীতে তাদের বসতবাড়ি ভেঙে যায়, পরে নদীতে চর জাগলে সেখানে গিয়ে বসতি স্থাপন করেন। মাত্র ৭বছর বয়সে দাদীর মৃত্যু হলে কিছুদিন পরেই অমৃত লালের কাকারা সংসার আলাদা করে ফেলেন।
১৯৩৯ সালে ১৫ বছর বয়সে পরিবারের অভাব অনটন ঘুচাতে তিনি যোগ দেন কার্তিকপুরের একটি বিড়ির কারখানায়, এরপরে ঘড়িষাড় বাজারের বিড়ির কারখানায় ১৪পয়সা মজুরিতে কাজ নেন, শেষে মুলফৎগঞ্জ বাজারের আকিজ বিড়ি ও বাঙালি বিড়ির কারখানায় কাজ নিয়েও সংসারের সবার খাবার জোটেনি ঠিকঠাক।
অভাবের দিনে প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনের বিলাসিতাও দেখেছেন, এক সাক্ষাৎকারে তিনি এই বিষয়ে বলেছিলেন ” আত্মীয়ের বিপদে আত্নীয়, স্বজনের বিপদে স্বজন, মানুষের বিপদে মানুষ এগিয়ে আসবে এমনটাই হওয়া উচিত। মানুষ কীকরে এতো নিষ্ঠুর হয় ভেবে পাই না।”
সেইসময় কলেরা ও ম্যালেরিয়ার ভয়াবহতা, পিতার অসুস্থতা, ১৯৪২ সালের আকাল সবকিছুই পাঁচগাঁও-এর মাটিতে দাঁড়িয়ে তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন। সংসারের বড় ছেলে হওয়ায় পিতামাতা, ৩ভাই ও ২বোনের ভরণপোষণের দায়িত্ব চাপে অমৃত লালের কাঁধে।
পিতা রাসমোহন দে একটু সুস্থ হলে বারান্দার টিন বিক্রি করে একসময় তার পিতা রাসমোহন দে, অমৃত লাল দে ও ভাই শান্তি দে পাড়ি জমান বরিশালে। ওখান থেকেই পাঁচগাঁও-এ নিয়মিত আসাযাওয়া করতেন অমৃত। অসুস্থ পরিবারের খোঁজখবর নেয়া খুব দূরুহ হয়ে যাওয়ায় পিতা রাসমোহন দে কয়েকমাস পরেই পঞ্চাশ টাকায় সম্পূর্ণ ঘরখানা বিক্রি করে পরিবার নিয়ে রওনা হন বরিশালে।
সেখানে অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে একসময় অমৃত লাল ও তার বন্ধু মিলে ১৯৪৮ সালে ১২টাকার পুঁজিতে পান ও বিড়ির দোকান শুরু করেন। সেখানেই প্রতিষ্ঠা করেন কারিকর বিড়ি। অমৃতের ব্যবসা যখন আলোর মুখ দেখতে শুরু করলো, তখন ১৯৪৭ সালের দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত পাকিস্তান ভাগের প্রভাব পড়তে শুরু করলো বরিশালে, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মুখে হিন্দুরা ভারতে ও মুসলিমরা পাকিস্তানে চলে যেতে লাগলো। অমৃতের পিতা কী করবেন বুঝে ওঠতে পারলেন না, তাই তিনি ছুটে এলেন জন্মভূমি পাঁচগাঁও-এ, তার আত্মীয়স্বজনের সাথে আলাপ করে ভারত যাবেন নাকি এদেশেই থাকবনে কোন সিদ্ধান্তে আসা যায় কিনা জানার জন্য। খোঁজ নিয়ে দেখলেন অনেকেই তখন পাঁচগাঁও থেকে ভারতে চলে গেছে।
সবকিছু উপেক্ষা করে অমৃত লাল বললেন “এই দেশে আমি জন্মেছি, এই মাটি আমার, দেশও আমার। এই দেশে বসবাস করার অধিকার আমার আছে।”
পিতা গ্রামের বাড়ি পাঁচগাঁও-এ এসে খবরের পাশাপাশি অমৃতের বিয়েও ঠিক করে এসেছেন কনের নাম যোগমায়া, বাড়ি বিক্রমপুরের টঙ্গীবাড়ীর গুয়াপাড়া গ্রামে। বিভীষিকাময় দোটানার মাঝেই পিতামাতার কথা রাখতে ১৯৫০ সালে অমৃত লাল দে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হন।
অনেক ভয়াবহ পরিস্থিতি অতিক্রম করে অমৃত লাল দে একজন সফল ব্যাবসায়ী হয়ে উঠেছেন কিন্তু তিনি কখনোই তার অতীত ভুলে যান নি।
অমৃত লাল তার পড়াশোনা নিয়ে আরও একটি স্মৃতিচারণে লিখেছেন যেদিন পয়সার অভাবে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেলো, সেদিন বাসায় এসে প্রচুর কেঁদেছি, মা আমায় শান্তনা দিয়ে বলেছেন সবার কি পড়াশোনার ভাগ্য হয়, দুনিয়ায় কত মানুষ পড়াশোনা না করেও বড় হয়েছে, একদিন তুইও অনেক বড় হবি বাবা।”
মায়ের সেই আশীর্বাদ একদম বাস্তবে প্রতিফলিত হয়েছে অমৃত লালের জীবনে। অভাবের কারণে পড়াশোনা না করতে পারা সেই অমৃত লালের স্পর্শ, মমতা লেগে আছে বরিশালের অগণিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। নিজ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা করেছেন অমৃত লাল দে মহাবিদ্যালয়, অমৃত লাল দে মেডিকেল কলেজ, পাঠাগার ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান।
অমৃত লালের মৃত্যুর পরে, ভাইদের তত্বাবধানে নির্মিত হয়েছে অমৃত লাল দে আয়ুর্বেদ ও ইউনানি মহাবিদ্যালয়, অমৃত লাল দে সংগীত একাডেমি, কিন্ডারগার্টেন, উচ্চবিদ্যালয়সহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠান।