না খেয়ে মরার উপক্রম কিন্ডারগার্টেন শিক্ষকদের, দেউলিয়ার পথে মালিকরা
মো: মনিরুজ্জামান::
রাহিমা আকতার (ছদ্দ নাম)। লেখাপড়ার পাশাপাশি টিউশনি করে নিজের হাত খরচটা চালাতেন। হঠাৎ সাংসারিক ঝামেলায় পন্ড হয়ে যায় রাহিমার পড়াশোনার স্বপ্ন। তবুও হাল ছাড়েননি। কারো বোঝা না হয়ে নিজেই চাকরি খুঁজতে বেড়িয়ে পড়লেন। একতো বয়স কম তারমধ্যে কর্মদক্ষতাও নেই। ফলে কোথাও চাকরি হলো না রাহিমার। টিউশুনি করার অভিজ্ঞতা নিয়ে বন্দরনগরী চট্রগ্রামের একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি নিলেন রাহিমা। স্কুলের বেতন বেশি না হলেও এর পাশাপাশি কয়েকটি টিউশুনি বাড়িয়ে মাসিক খরচ মেটানোর একটা ব্যবস্থাতো হলো।
বিশ্ব মহামারী করোনার আগমন দেশে। সরকারি নির্দেশনা মতে বন্ধ হয়ে গেল সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সরকারি নির্দেশনা মানতে গিয়ে বন্ধ হয়ে গেল রাহিমার টিউশুনিও। গার্ডিয়ানরা সন্তানদের পড়াতে সাহস পাচ্ছেন না। আবার অনেক গার্ডিয়ানের অনুরোধ থাকা সত্ত্বেও রাহিমা নিজের এবং তাঁর শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার জন্য গত ২০২০ সালে কোন ধরনের টিউশুনি করেন নি। আর বন্ধ থাকা স্কুল থেকেও বেতন পাওয়া হয়নি।স্কুল কতৃপক্ষ শিক্ষকদের বেতন পরিশোধ করবেতো দুরের কথা ভাড়া বাসায় পরিচালিত নিজের প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখা দ্বায়।
স্কুল কতৃপক্ষের এমন অবস্থা দেখে রাহিমা কেনো তার সহকর্মী কেউই বেতনের জন্য তাগাদা দিতে পারছিল না। নিজের উপার্জিত জমানো টাকা কমে যাওয়ায় রাহিমা এখন নিস্ব! বাবা-মাকে আর্থিক সহযোগিতা করার বিপরীতে নিজেই অন্যের সহায়তা নিতে হিমসিম খাচ্ছেন। রাহিমারা সরকারি বেসরকারি সাহায্য সহযোগিতা মুখফুটে চাইতে পারছেনা। কোথাও বিকল্প চাকরিও মিলছে না। এভাবেই গত একবছর যাবৎ রাহিমার আর্থিক অবস্থার চরম বিপর্যয় ঘটেছে।
রাহিমার মত একই বিপর্যায়ের সম্মুখীন জিহাদুল হাসান। কোথাও চাকরি না পেয়ে বিজ্ঞান বিষয় পড়াশোনা করা মেধাবী এই যুবক চাকরি নিয়েছিলেন কিন্ডারগার্টেন স্কুলে। কয়েকমাস বেতন পেলেও দেউলিয়া হতে চলা স্কুল মালিক শিক্ষকদের বেতন বন্ধ করে দিয়েছেন। না দিয়েবা উপায় কি? মাসের পর মাস জমে গেছে বকেয়া ভাড়ার টাকা। পরিশোধ করতে না পেরে কিন্ডারগার্টেন স্কুলের অনেকেই দেউলিয়া হয়ে গেছে। অনেকে পুরনো স্কুল বেঁচে দিয়ে সরে এসেছে এই শিক্ষাসেবা থেকে।
করবোনায় স্কুল বন্ধ। সরকার নির্দেশিত দেশের অধিকাংশ সরকারি স্কুল গুলোতে অনলাইন ক্লাস চালু অব্যাহত রয়েছে। সরকারি স্কুলের পাশাপাশি দেশের অধিকাংশ কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোতেও চলমান রয়েছে অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে পাঠদান। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ধারাবাহিকতা রক্ষায় সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সম্পূর্ ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো। লাইভ ভিডিও ধারণ করে শিশুদের বই খাতার সাথে সম্পৃক্ত রাখার চেষ্টা।
দীর্ঘ ছুটিতে স্কুল পড়ুয়া কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার প্রতি আগ্রহে চরম ভাটা পড়েছে। ফলে চলতি বছরে অনেক স্কুলের পূর্বের বছরের বইয়ের চাহিদা পত্র সংশোধন করে নতুন চাহিদার বিপরীতে কম সংখ্যক বই বিতরণ করা হয়েছে। ভর্তির পরে আর খুঁজে পাওয়া যায় নি অনেক শিক্ষার্থীদের। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত এক অনুসন্ধানে জানাযায়, কোন একটি স্কুলে ২০২০ সালে মোট শিক্ষার্থীর এক-তৃতীয়াংশ এ বছরে আর ভর্তি হয়নি। ভর্তির পরেও অনেকে বই নিতেও আসেনি। এমন বাস্তবতায় স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থী ঝড়ে পড়ার আশংকা দেখা দেয়।
শিক্ষার্থী ঝড়ে পড়ার হার ঠেকাতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোঁজ নিচ্ছেন সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরা। অনলাইন ক্লাস এর পাশাপাশি নিয়মিত পাঠদান চালিয়ে যাচ্ছেন শিক্ষকরা। এছাড়াও হয়াটস এ্যাপ, ম্যাসেন্জার সহ বিভিন্ন মাধ্যমে শিক্ষার্ীদের প্রয়োজনীয় পরামর্ দিচ্ছেন। এতো কিছু করেও স্কুলের টিউশুন ফি আদায় করা সম্ভবপর হচ্ছে না। অথছ সরকারিভাবে টিউশন ফি আদায়ে কোন বিধিনিষেধ নেই।
এই ক্লান্তিকালে চরম ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে দেশের কিন্ডার গার্ন। প্রায় বন্ধ হবার উপক্রম দেখা দিয়েছে ব্যক্তি মালিকানাধীন গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানগুলোর। স্বাস্থবিধি মেনে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান চালু করা হলেও বন্ধ রয়েছে কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলো। ফলে করোনা ভাইরাসের সংকটময় মুহুর্তে সবচেয়ে বেশি অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে কিন্ডারগার্টেন স্কুল।
বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় সরকারের পাশাপাশি এসব স্কুলগুলোতে পাঠদানে ইতিমধ্যে খ্যাতি অর্জন করেছে। সরকারের সহায়ক হিসেবে কেজিস্কুল গুলোর মানন্নোয়নের উজ্ঝল সম্ভাবনা আজ শোচনীয় অবস্থায় পড়েছে।
একটি সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে দেশে প্রায় ৬৫ হাজার কিন্ডারগার্টেন গড়ে উঠেছে। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ১ কোটিরও বেশি শিক্ষার্ী লেখাপড়া করছে। এছাড়াও কর্মরত রয়েছে দশ লাখেরও অধিক শিক্ষক-শিক্ষিকা ও কমচারী। কে দেখবে কার দূ:খ! শিক্ষকের ব্যনার নিয়েও কেহ রাস্তায় দাঁড়াতে পারছে না!
আমাদের সম্মানিত গার্ডিয়ানরা অনেক সচেতন! করোনায় তাঁদের অনেক অভাব, আগের থেকেও অনেক বেড়ে গেছে অভাবের মাত্রা! মার্কেট করা, দৈনন্দিন জীবন এর সমস্ত খরচে সম্মানিত গার্ডিয়ানদের কোথাও কোনো অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
তবুও স্কুলের মাত্র তিন চারশত টাকা মাসিক টিউশন ফি দিতে যতো করোনা অযুহাত। অনেকেতো ছেলে-মেয়ের পড়াশোনা বন্ধ করে দিবেন বলে হুমকি দিতে থাকেন। প্রসঙ্গের আলাপচারিতায় ঠাট্টা করে এক ভদ্রলোক বললেন, দেখেন গিয়ে ওনাদের (কথিত অভাবী)বাসায় ডিস চলছে, ফেসবুক চলছে অথছ স্কুলের টিউশন ফি ৩/৪শ টাকা না দেয়ার জন্য নানা অযুহাত দেখাচ্ছে। ভদ্রলোকের কথাটি তিতা হলেও সঠিক্ ।
আমরা শিক্ষক প্যানেল প্রতিটি বাসায় বাসায় গিয়েছি। কার কি অবস্থা সরাসরি জেনে এসেছি। নিলর্জ্জের মতো আমাদের সেবা এবং আমাদেরও আর্থক সমস্যার কথা বুঝিয়েছি। আর কতো বোঝাবো? ওই কথা একটাই স্কুল বন্ধ কিসের বেতন কিসের টাকা! আমি সব গার্ডিয়ানের বেলায় এমন চিত্র দেখিনি। রাহিমা, জিহাদুলের মতো শিক্ষকদের দুরবস্থার কথা বিবেচনা করে অনেক গার্ডিয়ান তাঁদের বেতন পাওয়া মাত্র স্কুলে এসে সন্তানদের নিয়মিত বেতন পরিশোধ করছেন।
সন্তানদের পড়াশোনার উন্নতির জন্য শিক্ষকদের সাহায্য সহযোগিতা কামনা করছেন। অনেক গার্ডিয়ান টাকা দিতে না পারলেও শিক্ষকদের বিপদমুহুর্তে শান্তনা দিচ্ছেন। সৃষ্টিকর্তা না চাইলে চিরদিন করোনা থাকবে না। ধিরে ধিরে কেটে যাবে শিক্ষকদের এমন কঠিন বিপর্যয়। কিন্তু বাস্তবটা হলো এই অপেক্ষার সময় টা যতই বাড়ছে ততই কিন্ডারগার্টেন শিক্ষকদের হতাশা, হাহাকার ধর্য্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। দৈনন্দিন খাবারের তালিকা সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। হতাশাগ্রস্থ অনেক শিক্ষক বেঁচে থাকার তাগিদে পেশা বদল করে নিরবে নিবৃত্তে কাঁদছে!
এই সমাজে কারা বেশি অসহায় হয়ে পড়েছে সে প্রশ্ন পাঠকের নিকট ছুঁড়ে দিলাম। কে বোঝে কার বুঝ? আমাদের সচেতন গার্ডিয়ানরা সবই বোঝেন। সবই চোখে দেখেন। শিক্ষক বলে কথা! মানুষ গড়ার কারিগর সেই শিক্ষকরা আজ জাতির বিবেকের কাঠগড়ায়। করোনার ভয়ংকর থাবা থেকে এক বছরেরও অধিক সময় ধরে কুল কিনারা হয়নি শিক্ষকদের। আমাদের সুশীল সমাজ নানা দাবি নিয়ে সরব থাকলেও কিন্ডাগার্ন স্কুল তথা িএসব স্কুলের সাথে জরিত শিক্ষকদের আর্তনাদ অনুভব করবেন প্রত্যাশা রইলো………….!