বরিশালে খোকনের নৌকার ‘কাঁটা’ অভ্যন্তরীণ কোন্দল, আলোচনায় তাপসের লাঙ্গল
অনলাইন নিউজঃ আর একদিন পরেই বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচন। এখানেও গাজীপুরের ভয় তাড়া করছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে। দলীয় কোন্দলে এখানেও নৌকাডুবির আশঙ্কা করছেন নেতাকর্মীরা। তবে পরিস্থিতি সামলে জয়ের মালা ছিনিয়ে আনতে শেষ মুহূর্তের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন দলের কান্ডারিরা।
বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বর্তমান মেয়র সাদিক আবদুল্লাহকে বাদ দিয়ে প্রার্থী করা হয় তার চাচা খোকন সেরনিয়াবাতকে। সাদিক আবদুল্লাহ মনোনয়ন বঞ্চিত হওয়ার পর থেকেই স্থানীয় আওয়ামী লীগে অন্তঃকোন্দল চলছে। বরিশালে গাজীপুরের পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে এরই মধ্যে কৌশল পাল্টিয়ে মানুষের দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে ভোট চাইছে আওয়ামী লীগ। তবে সাদিক অনুসারীরা নৌকার বিরোধিতা করছেন বলে অভিযোগ করেছেন নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্যরা। বিএনপির অনুপস্থিতি ও আওয়ামী লীগের কোন্দলের সুযোগে বাকি তিন প্রার্থী লাঙ্গলের ইঞ্জিনিয়ার ইকবাল হোসেন তাপস, হাতপাখার মুফতি সৈয়দ ফয়জুল করীম ও স্বতন্ত্র প্রার্থী কামরুল আহসান রুপন ভোট বাগাতে মাঠে কাজ করেছেন দিনরাত।
সরকারবিরোধী বিভিন্ন বক্তব্য দিয়ে ভোটারদের মধ্যে আলোড়ন তুলেছেন লাঙ্গলের ইঞ্জিনিয়ার তাপস। হাতপাখার ফয়জুল করীমও ভোটের মাঠে প্রথম দিকে বেশ সাড়া ফেলেছিলেন। এরপর প্রচারকাজে ধর্মের ব্যবহারের অভিযোগ তোলেন স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী আসাদুজ্জামান। এছাড়া নৌকার পরাজয়ে তিন কোটি টাকা হাতপাখার প্রার্থীকে দিয়েছেন আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ও মেয়র সাদিক আবদুল্লাহ- এমন অভিযোগ তোলেন এক কাউন্সির। এই দুই অভিযোগের ফলে ভোটারদের মধ্যে বিরূপ প্রভাব পড়েছে বলে ধারণা নগরবাসীর।
এর বাইরে স্বতন্ত্র প্রার্থী রুপন বিএনপির একটি পক্ষের সমর্থনে নির্বাচন করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এই কারণে তিনি ট্রাম্পকার্ড হতে পারেন। নৌকার নেতাদের দাবি, বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা তেমন প্রভাব ফেলবে না। তবে নির্বাচনের শেষ মুহূর্তে বিএনপির অংশগ্রহণ ছাড়াই ভোটের হিসাব-নিকাশ জটিল হয়ে পড়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমান মেয়র সাদিক নৌকার মনোয়ন বঞ্চিত হওয়ার পর গত ১ মে সাদিক ও নৌকার প্রার্থী খোকনের সমর্থকরা পৃথক কর্মসূচি করেন। এই কর্মসূচি উপলক্ষে সাদিক সমর্থিত শ্রমিক নেতাদের নেতৃত্বে নগরীতে বিশাল শোডাউন করা হয়। এরপরই অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। তারপর থেকে নির্বাচনি কাজে মহানগর ও জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ কয়েকজন নেতাকে দেখা গেলেও কর্মীরা মাঠে কাজ করছেন বিরোধী অবস্থানে থেকে।
এছাড়া সাদিক সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীদের বিরুদ্ধে হাতপাখায় ভোট চাওয়ার অভিযোগ তুলেছেন নৌকার প্রার্থীর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্যরা। তাদের দাবি, ১২ জুনের নির্বাচনে বিজয়ী হলে স্মার্ট বরিশাল গড়ার অঙ্গীকার জনমনে ব্যাপক সাড়া ফেলেছেন খোকন। গত ১০ বছর বরিশাল উন্নয়ন বঞ্চিত হওয়ায় ভোটাররা উন্নয়নের স্বার্থে জোট বেঁধেছে।
তবে গাজীপুরের মতো বরিশালেও যদি নৌকা হারে তবে বিশ্বাস ঘাতকদের ছাড় দেওয়া হবে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন কেন্দ্রীয় নেতারা।
নৌকার প্রার্থী খোকন সেরনিয়াবাত আক্ষেপ করে কয়েক দিন আগে বলেছিলেন, আমি বরিশালে একা। এখানে আমার কোনো অভিভাবক নেই। নৌকার পক্ষে স্থানীয় আওয়ামী লীগের একাংশের নেতাকর্মীদের দেখা না যাওয়া প্রসঙ্গে শুক্রবার কেডিসি এলাকায় অবস্থানকালে বলেছিলেন, যারা নৌকার বিরোধিতা করে তা তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। দলের প্রতি দায়িত্ববোধ থাকলে এমন কেউ করতে পারেন না। আমি সবাইকে নিয়ে নতুন বরিশাল গড়তে চাই।
প্রথম দিকে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হাতপাখা থাকলেও শেষ মুহূর্তে পরিস্থিতি কিছুটা পাল্টে গেছে। জাতীয় পার্টির লাঙ্গল প্রতীকের প্রার্থী ইঞ্জিনিয়ার ইকবাল হোসেন তাপস অনেকটা আলোচনায় চলে এসেছেন। এর পেছনে কাজ করেছে নির্বাচনি মাঠে সরকারবিরোধী বক্তব্য। এই বক্তব্যের কারণে আওয়ামী লীগের বিপরীত মেরুর ভোটাররা তাকে পছন্দের তালিকায় রেখেছেন।
সাবেক মেয়র শওকত হোসেন হিরনের বন্ধু হওয়ায় নগরবাসী তাপসের মাঝে হিরনের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছেন। ফলে হিরনকে ভালাবাসে এমন সাধারণ মানুষের ভোট তার বাক্সে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তিনি এই নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া নিয়ে প্রথম থেকেই শংকা প্রকাশ করে আসছেন।২০ বছর আগে পৌরসভা থেকে বরিশাল সিটি করপোরেশনে রূপান্তর হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত চারবার নির্বাচন হয়েছে। এর মধ্যে দুইবার আওয়ামী লীগ এবং দুই বিএনপির প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছেন।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম প্রতীক বরাদ্দের আগে থেকেই বলে আসছিলেন নির্বাচনের ফল ঘোষণা না হওয়া পর্যন্ত তিনি শঙ্কামুক্ত নন। শনিবার (১০ জুন) তিনি জানিয়েছেন ভোটের মাঠের পরিবেশ সুষ্ঠু ও সুন্দর রয়েছে। ইসলামী আন্দোলনের এই প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রচারকাজে ধর্মের ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। এই ঘটনায় রিটার্নিং কর্মকর্তা তাকে ডেকে সতর্কও করেন। এছাড়া নৌকাকে হারাতে তিন কোটি টাকা দিয়েছেন আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ও মেয়র সাদিক আবদুল্লাহ- এমন অভিযোগ করেন সাদিকবিরোধী কাউন্সিলর শরীফ মো. আনিসুর রহমান। তবে এসব অভিযোগ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন দাবি করে ফয়জুল করীম বলেছেন, হাতপাখার জনসমর্থনে ঈর্ষান্বিত হয়ে এই অপপ্রচার চালাচ্ছে একটি পক্ষ। এসব কাজে জড়িত হওয়ার প্রশ্নই আসে না।
এদিকে বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নিলেও সাবেক মেয়র আহসান হাবিব কামালের ছেলে কামরুল আহসান রুপন নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। তিনি তার প্রচারণায় বলেছেন, ‘ধানের শীষে ভোট দিয়েছেন যারা, ঘড়ি মার্কায় ভোট দেবেন তারা।’ এরপরই বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়। বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নিলেও রুপন অংশ নিয়ে দল থেকে আজীবন বহিষ্কার হয়েছেন। তবে রুপনের পেছনে স্থানীয় বিএনপির একটি অংশের সমর্থনে রয়েছেন অভিযোগ ওঠেছে। বিএনপির এই গ্রুপের ভোট পেলে তিনিও শক্তিশালী প্রার্থী হয়ে উঠতে পারেন। তবে এসব অভিযোগ রুপন উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, কেন্দ্রীয় একজন সাংগঠনিক সম্পাদক এসব ষড়যন্ত্র করছেন। এছাড়া অন্যান্য অভিযোগও মিথ্যা বলে দাবি তার।
নৌকার নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য ও বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মীর আমিন উদ্দিন মোহন ঢাকা মেইলকে বলেন, নির্বাচনি কাজে কে এলো আর কে এলো না তাতে আমাদের কিছু আসে যায় না। গত সাড়ে চার বছর নগরীতে কোনো উন্নয়নতো হয়ইনি, উল্টো বেপরোয়া অত্যাচার নির্যাতনের শিকার হয়েছেন নগরবাসী। নগরবাসীর সেবা নিশ্চিতের জন্য খোকন সেরনিয়াবাতকে মনোনয়ন দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। খোকন সেরনিয়াবাত মনোনীত হওয়ায় নগরবাসী আনন্দিত। সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে নৌকার সঙ্গে রয়েছি। যারা মাঠে নামেননি, তারা আমাদের সঙ্গে কাজ করলে ভোটারদের কাছে ভুল বার্তা যেত। আমাদের প্রচার-প্রচারণায় আস্থা ফিরে পেয়েছে নগরবাসী। তারা নৌকাকে বিজয়ী করতে ১২ তারিখের অপেক্ষায় রয়েছেন।
বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট একেএম জাহাঙ্গীর বলেন, বরিশাল আওয়ামী লীগে কোনো বিভক্তি নেই। বিভক্তির কথা যারা ছড়াচ্ছেন তারা নৌকার ভালো চান না। আমরা প্রথম থেকেই আমাদের রাজনৈতিক অভিভাবক আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর নির্দেশনায় নৌকার পক্ষে মাঠে কাজ করে যাচ্ছি।
এই নির্বাচনে অন্যান্য মেয়র প্রার্থীরা হলেন জাকের পার্টির মিজানুর রহমান বাচ্চু, স্বতন্ত্র আলী হোসেন হাওলাদার ও আসাদুজ্জামান আসাদ।
২০ বছর আগে পৌরসভা থেকে বরিশাল সিটি করপোরেশনে রূপান্তর হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত চারবার নির্বাচন হয়েছে। এর মধ্যে দুইবার আওয়ামী লীগ এবং দুই বিএনপির প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছেন। আগামীকাল ১২ জুন বরিশাল সিটি করপোরেশনের পঞ্চম পরিষদের নির্বাচন। ৫৮ বর্গকিলোমিটারের এই নগরীতে মোট ভোটার দুই লাখ ৭৬ হাজার ২৯৮ জন। তাদের মধ্যে নারী ভোটার এক লাখ ৩৮ হাজার ৮০৯ জন। এছাড়া পুরুষ ভোটার রয়েছেন এক লাখ ৩৭ হাজার ৪৮৯ জন।সূত্রঃঢাকামেইল