তোমরা দেশকে শিক্ষিত শিক্ষক দাও,দেশ আমাদের শিক্ষিত জাতি উপহার দিবে
ইকবাল হোসেন তাপসঃ
“ নেপোলিয়ান বোনাপার্টের সেই বিখ্যাত উক্তিটি জীবনে আমারা অনেকেই অনেকবার শুনেছি আজ জনাব নেপোলিয়ান বেঁচে থাকলে হয়ত বাংলাদেশর জন্য বলতেন – “ তোমরা বাংলাদেশকে শিক্ষিত শিক্ষক দাও , দেশ তোমাদেরকে শিক্ষিত জাতী উপহার দিবে। “ ২২ বৎসর বয়সে জাপান যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল জাপানি ভাষা শিক্ষার ছাত্র হিসাবে । সেই সুবাদেই জাপানি শিক্ষকদের কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। দেখার সুযোগ হয়েছে শিক্ষকরা ছাত্রদের প্রতি কতটা আন্তরিক ও সদয়।
আমারা যেভাবে আমাদের শিশু সন্তানদের অক্ষরজ্ঞান সহ জীবনের প্রীতিটা প্রয়োজনীয় বিষয় শিক্ষা দিতে শুরু করি ঠিক তেমনি করে আমার মতো আরও অনেক ২২/২৫ বৎসরের ছেলেমেয়দেরকে তাদের ভাষা ও সমাজ ব্যাবস্থা শিক্ষা দেয়ার যে চেষ্টা ও আন্তরিকতা আমি আমি দেখেছি ঠিক যেমনি একজন প্রাইমারী স্কুলের বাচ্ছাদের শিক্ষা দেয়া হয়।
কোন শিশু যখন তার স্কুল জীবন শুরু করে শিক্ষক তার হৃদয়ের মধ্যে খোদাই করে বসিয়ে দেন কিভাবে তাঁর ভবিষ্যৎ জীবন পরিচালনা করবে ,কিভাবে মানুষের সাথে আচরণ করবে ,দেশের সাথে সমাজের সাথে কি আচরণ করবে, মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা, দেশ প্রেম, পোশাক আশাক ,চলাফেরা, খাওয়া দাওয়া, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা এক কথায় একজন ভাল নিষ্ঠা বান সামাজিক মূল্য বোধ সম্পন্ন মানুষ হওয়ার জন্য যে সকল শিক্ষা প্রয়োজন সবই একজন শিক্ষকের পক্ষে দেওয়া সম্ভব যদি সেই শিক্ষক হন শিক্ষিত।
যে শিক্ষক তার নিজ জীবনে এমন শিক্ষা পান নাই তার কাছে আমরা এমন শিক্ষা আশা করি কিভাবে? সেটা জাপানে সম্ভব শিক্ষকরা জুনিয়র স্কুল পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের এমন ভাবে শিক্ষিত করেন পরবর্তী জীবনে তাঁরা সেই আদর্শের বাহিরে আর কোনদিন যেতে পারে না। আমার দেখা পৃথিবীর সেরা সুশৃঙ্খল জাতী। যার মূলমন্ত্র শিক্ষা এবং সুশিক্ষিত শিক্ষক। সকল শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে আমদের প্রাইমারী শিক্ষার দিকে একটু ফিরে তাকাই।
আমি অনেকের মতই বাংলাদেশের একটি অনুন্নত গ্রামের সন্তান। আমি যখন প্রাইমারী স্কুলে পড়ি তখন আমার গ্রামে কোন প্রাইমারী স্কুল ছিল না। আমার পাশের গ্রামের স্কুলে পড়তাম। আমার একজন শিক্ষক ছিলেন তার বাড়ি ছিল স্কুল সংলগ্ন। তিনি প্রতিদিন স্কুলে আসতেন একটি গরু একটি ছাগল ও একটি বেত নিয়ে যা দিয়ে গরু ছাগল ও ছাত্রদের এক সাথে শিক্ষা দেওয়া যায় । স্কুলের পাশের মাঠে ছাগল ও গরুটি কে পারকিং করে তিনি আসতেন আমদের পড়াতে। এসেই দু একটা হাঁকডাক মেরে টেবিলের উপরে পা উঠিয়ে ঘুম।
একবার আমাদের ক্লাসের আঃ বারেক স্যারের ঘুমন্ত মুখে কচু পাতায় করে পানি এনে ঢেলে দিয়েছিলো। সেই যে বারেক নিরুদ্দেশ আর স্কুলে আসলো তিন মাস পড়ে। তাই বলে অন্য সকল শিক্ষকও যে তার মতো ছিল এমনটা বলছি না। আমাদের কালা হুজুরের মুখের পানের জড়দার ঘ্রান তো এখনও মনে পড়ে ।ছোটবেলায় অনেক বার মনে হয়েছিলো কবে যে বড় হবো আর হুযুরের মতো পান খাব।
আমি তখন চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ি আমাদের একজন নতুন হেড মাস্টার আসলেন। যতদূর মনে পড়ে তার বাড়ি ছিল বরগুনার দিকে । তাই তার ঠাই হল আমাদের বাড়িতে লজিং মাস্টার হিসাবে। তিনি আমাকে কি কি শিখিয়েছিলেন সব মনে নাই তবে কৈ মাছের জাল আর মাছ ধরার চাই কিভাবে বানাতে হয় আর কিভাবে আজান দিতে হয়ে সেটা তিনি নিশ্চয়ই শিখিয়েছিলেন। করোনা বিশ্রামে যেহেতু কোন কাজ ও বন্ধুও নাই তাই ছোট ছেলেটার সাথে বন্ধুত্বটা আরও ঘনিষ্ঠ হয়েছে। ছোট ছেলেটা আর ছোট নাই সে এখন প্লেন চালানো শিখে ফেলেছ।
গত রাতে তার সাথে আমদের শিক্ষা কাল আর তার শিক্ষা কালের অভিজ্ঞতা বিনিময় করছিলাম। সে রাজধানীর সেরা স্কুলের একটি মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলে পড়ত। মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলে ভর্তি হলেছিলে ক্লাশ সিক্সে । প্রথম দিন ক্লাসে তার স্যার তাঁকে প্রথম প্রশ্ন করল ফজরের নামাজ পরেছে কিনা। সে বলল না স্যার আর অমনি সপাং সপাং দুই থাপ্পর তার দু গালে। বীতশ্রদ্ধভাবে তার প্রথম দিনের অভিষেকের কথা তুলে ধরলেন। তারপরের আরও অনেক গল্প আছে কিন্তু এতকিছু আলোচনা করা যাবে না কারন হাবুল স্যার বলেছেন গল্প বেশী বড় করা যাবে না।
১৯৯১ সালের কথা আমার জীবনের অনুপ্রেরনা জাপানি ভদ্র লোক মিতসুমুরা সাহেব আমার সাথে বাংলাদেশে আসেন , আমি তাঁকে নিয়ে চট্টগ্রামে যাই। চট্টগ্রাম শহরের চৌ মহুনি বাজারের সিংনালে পাক্কা ৪০ মিনিট আটকে গেলাম যা ছিল শুধু একটা রিকশার জটলা মাত্র। এই জটলা দেখে তিনি হতাশ হয়ে এই জটলার অবসান কবে হতে পারে আমার মতামত জানতে চাইলেন। আমি কোন কিছু না ভেবেই বলেছিলাম ২০/২৫ বৎসর তো লাগবেই। আজ ২৯ বৎসর পড় তার কথাটি মনে পড়লো। ভেবে দেখলাম রিকশার জটলা তো কমে নাই বরং বেড়েছে।
মিতসুমুরা সাহেব বলেছিলেন এই জটলা আগামী ৫০ বছরেও শেষ হবে না। অবস্থা দৃষ্টে তাই মনে হচ্ছে। ছোট বেলা থেকেই বিশৃঙ্খলা, অনিয়ম, অবহেলা, দুরনিতি,ঘুষ , মানুষে মানুষে অশ্রদ্ধাবোধ, মানবতা বোধের অভাব ,দেখতে দেখতে হাঁপিয়ে উঠেছি। সকল অনিয়ম গুলোই আজ যেন নিয়মে পরিনত হয়ে আছে। ছোট বেলায় সোনালী সিনেমা হলে সিনেমা দেখতে গিয়ে টিকিট কাঁটা ছিল টিকিট কাঊনটারের ছোট ছিদ্রের মধ্যে ৩/৪ জনে একসাথে হাত ঢুকিয়ে হাতের চামড়া ছোলা আর জামার বুতাম ছিঁড়া ।
বাসের একটি দরজা দিয়ে এক সাথে দশ বারো জনের একসাথে ওঠার চেষ্টা করা। বাঙ্গালীর প্রবাদ বাক্য “ নিজে বাঁচলে বাপের নাম।“ এই ছিল শিক্ষা । শিক্ষকদেরই বা দোষ কি তাঁরই বা শিক্ষিত হতে পারলেন কই। দু একটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্মের ইতিহাস তুলে ধরলে হয়ত শিক্ষকদের ইতিহাস পাওয়া যাবে। আমাদের গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭৮ সালে আর যেটা সরকারী হয় ১৯৮৬ সালে। আমাদের এই বিদ্যালয় দেখে পাশের গ্রামে আরও একটি বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্মের নিয়ম বড় অদ্ভুত।
কেউ একটা স্কুল চালু করবেন আর সেখানে কিছু অচল … বিনা বেতনে দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করবেন তার পড়ে কোন একদিন সেই স্কুল সরকারী হবে আর সেই সব অচলরাই হাল ধরবেন জাতীর ভবিষৎ গঠনের। আমাদের মস্ত বড় ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার , মাওলানা হওয়ার আগে প্রয়োজন ভাল একজন মানুষ হওয়া। সবার আগে প্রয়োজন একটা সুশৃঙ্খল জাতী যারা লাইন ভঙ্গ করবে না, দুর্নীতি করবে না , ঘুষ খাবে না, মিথ্যা কথা বলবে না , ভোট চুরি করবে না, আইন অমান্য করবে না, বিনা লাইসেন্সে গাড়ী চালাবে না , অন্যায় ভাবে ওভার টেইকিং করবে না, বিনা প্রয়োজনে হর্ন বাজাবেনা, দুর্ঘটনা ঘটিয়ে পালাবে না, গন পিটুনি দিয়ে মানুষ হত্যা করবে না, যেখানে সেখানে ময়লা ফেলবে না , ত্রানের চাল চুরি করবে না ।
এজন্য জন্য দরকার শিক্ষিত শিক্ষক একমাত্র শিক্ষকরাই বদলে দিতে পারে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মন মানসিকতা , খোদাই করে দিতে পারে শিশুদের মনে তাদের অনাগত ভবিষ্যৎ তাঁরা কেমন মানুষ হবে। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১২৫ বৎসর পূর্বে বাঙ্গালী জাতিকে নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছিলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বারবার কবি গুরুর সুরে এই জাতিকে নিয়ে হাতাশা প্রকাশ করে ছিলেন যার বিন্দুবিসর্গ পরিবর্তন আমাদের আজও হয় নাই। আজকের এইদিনে এসে আমাদের আবারো বলতে হচ্ছে …।“ সাত কোটি বাঙ্গালিরে হে মুগ্ধ জননী রেখেছ বাঙ্গালি করে মানুষ করোনি”
লেখকঃ ইকবাল হোসেন তাপস, যুগ্ন-মহাসচিব, জাতীয় পার্টি।