ডাকসু নির্বাচনে হেভিওয়েট প্রার্থীদের জনপ্রিয়তা বাস্তব নাকি শুধুই ‘মিডিয়া হাইপ’?

নিউজ ডেস্ক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন ঘিরে ক্যাম্পাসজুড়ে জমে উঠেছে প্রচার-প্রচারণা। প্রার্থীরা হলে হলে ঘুরছেন, যাচ্ছেন ভোটারদের দ্বারে দ্বারে। শিক্ষার্থীদের প্রতিটি ভোট লুফে নিতে চলছে তীব্র প্রতিযোগিতা।
যেসব প্রার্থীকে ‘হেভিওয়েট’ হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে তাদের নিয়ে সবচেয়ে বেশি কৌতূহল তৈরি হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে টেলিভিশন টকশো, সংবাদপত্রের শিরোনাম— সব জায়গায় তাদের নিয়ে মাতামাতি। প্রশ্ন হচ্ছে, এই জনপ্রিয়তা কতটা বাস্তব; নাকি এটি কেবল গণমাধ্যমের নিজেদের তৈরি এক ধরনের ‘হাইপ’?
ছাত্র-রাজনীতিতে দীর্ঘদিন সক্রিয় থাকা এবং দলীয় পরিচয়ের কারণে অনেক প্রার্থীকে শুরু থেকেই হেভিওয়েট ধরা হচ্ছে। ক্যাম্পাসজুড়ে যেখানেই তারা যাচ্ছেন, সাংবাদিকরা তাদের ঘিরে ধরছেন ভিডিও ফুটেজ ও সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য। এতে মাঝে মাঝে বিড়ম্বনায় পড়তেও দেখা গেছে প্রার্থীদের।
বিশেষ করে ছাত্রদলের মনোনীত ভিপি (সহ-সভাপতি) প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান এবং ছাত্র শিবিরের ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট প্যানেলের ভিপি প্রার্থী আবু সাদিক কায়েমকে নিয়ে গণমাধ্যমে ব্যাপক কাভারেজ থাকলেও অন্যান্য প্যানেল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নিয়ে তেমন মাতামাতি নেই।দলীয় আদর্শিক রাজনীতি করার কারণে কয়েকটি প্যানেলের প্রার্থীর নির্দিষ্ট ভোটার রয়েছে। এটা তাদের জন্য ইতিবাচক। তবে, তাদের নিয়ে গণমাধ্যমে যেমন মাতামাতি দেখা যাচ্ছে, বাস্তবে শিক্ষার্থীরা তাদের নিয়ে কী ভাবছে তা ভোটের পরেই বোঝা যাবে
যোগ্যতার ভিত্তিতেই প্রতিনিধি চান শিক্ষার্থীরা
ঢাকা পোস্টকে সাধারণ শিক্ষার্থীরা জানান, গণমাধ্যমের প্রভাব অস্বীকার করা যায় না। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিয়মিত লাইভ, ভিডিও ও স্ট্যাটাসের মাধ্যমে প্রার্থীরা নিজেদের জনপ্রিয় করে তুলতে চাইছেন। তবুও ছাত্রদের একটি বড় অংশ এখনো প্রার্থীদের ব্যক্তিগত ও একাডেমিক পরিচয় এবং সাংগঠনিক অতীত বিবেচনায় রাখছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী জিলহজ্জ শেখ বলেন, “শিক্ষার্থীদের মতে, প্রচারণায় দৃশ্যমানতা মানেই জনপ্রিয়তা নয়। কিছুদিন আগেও যাদেরকে সবচেয়ে জনপ্রিয় মনে হচ্ছিল, তাদের প্রচারণা ও দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে তারা আজ আলোচনায় নেই। বিশেষ করে একটি সংগঠন থেকে এক পদে একাধিক প্রার্থী থাকা দলীয় ভারসাম্যহীনতাই নির্দেশ করে।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আহসান হাবিব প্রান্ত বলেন, “গণমাধ্যমে প্রার্থী হিসেবে কয়েকজনকে বারবার এনে হেভিওয়েট তকমা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু যারা নির্বাচনে ভালো করার ক্ষমতা রাখে, সেই প্রকৃত স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রচারণা শিক্ষার্থীদের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, “ডাকসু সাধারণ শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের বাতিঘর। নির্বাচিত নেতাদের অবশ্যই শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি হওয়া উচিত, কোনো রাজনৈতিক দলের এজেন্ডা বাস্তবায়নকারী বা সুবিধাবাদী হওয়া উচিত নয়। ক্যাম্পাসে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই পড়াশোনা করতে আসে, কোনো রাজনৈতিক দলের শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে নয়। সুতরাং এমন ব্যক্তি বা জোটকে ভোট দেওয়া উচিত, যারা কোনো মূল দলকে সেবা দেবে না বা তাদের হয়ে কাজ করবে না, বরং তারা শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্যই কাজ করবে।”
ডাকসু নির্বাচনে হেভিওয়েট প্রার্থী কেবল গণমাধ্যমের ‘সাজানো হাইপ’
সমন্বিত শিক্ষার্থী সংসদ প্যানেলের ভিপি প্রার্থী জামাল উদ্দিন খালিদ বলেন, “আমার কাছে মনে হচ্ছে, গণমাধ্যমে হেভিওয়েট প্রার্থী বলে যাদেরকে হাইলাইট করা হচ্ছে, সেটাও প্রচারণার অংশ। আমরা যারা ভোটের মাঠে আছি, তাদের কাছে এটাকে সাজানো হাইপ মনে হচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, “দলীয় প্যানেলের বাইরে আমরা যারা মাঠে আছি, গণমাধ্যম বাস্তবে তাদের ধরছেই না। এমনকি হাইপের কাতারে রাখছে না। দলীয় বিবেচনায় যারা সামনে এসেছে এবং দলীয় লজিস্টিক সহায়তা নিয়ে প্রচারণায় নেমেছে, তাদেরকে গণমাধ্যম সাজানো হাইপে তুলে দিচ্ছে।”
স্বতন্ত্র জিএস প্রার্থী ও ঢাবির আইন বিভাগের শিক্ষার্থী আরাফাত চৌধুরী বলেন, “যাদেরকে গণমাধ্যমে হেভিওয়েট হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে, তাদের সবাই ৫ আগস্ট পরবর্তী সময় থেকে সক্রিয় হয়েছে এবং ডাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক ক্যারিয়ার গড়ার জন্য মরিয়া হয়ে আছে। তারা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে এবং শিক্ষার্থীদের অধিকার বাস্তবায়নের জন্য তাদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। তবুও গণমাধ্যম তাদেরকে হেভিওয়েট বলে প্রচারণা চালাচ্ছে যা সত্যি হতাশাজনক। প্রকৃতপক্ষে যারা মেধাবী ও যোগ্য শিক্ষার্থী প্রতিনিধি, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে শিক্ষার্থীরা ঠিকই তাদেরকে বেছে নেবে।”
গণমাধ্যমের হাইপ নিয়ে কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সেক্রেটারি মাহাদী হাসানের সঙ্গে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, “ডাকসু হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের কেন্দ্র করে একটি নির্বাচন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈধ শিক্ষার্থীরাই এর ভোটার এবং প্রার্থী হওয়ার যোগ্য। কিন্তু ডাকসু নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পর আমরা লক্ষ্য করেছি, বাংলাদেশের মূলধারার গণমাধ্যম ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলো এই নির্বাচনকে শিক্ষার্থীদের পরিসর থেকে বের করে এনে জাতীয় ইস্যুতে রূপ দিয়েছে।”
“এর ফলে শিক্ষার্থীদের মাঝে আসলেই কোনো প্রার্থীর জনপ্রিয়তা আছে কি না— তা যাচাই না করে, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা না বলেই গণমাধ্যমগুলো অতিরঞ্জিতভাবে তাদের জনপ্রিয়তা প্রচার করছে। তথাকথিত এই গণমাধ্যমগুলোতে যেভাবে কিছু প্রার্থীকে জনপ্রিয় হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে, আসলে তারা কতটা জনপ্রিয় তা ভোটের দিনেই নির্ধারিত হবে বলে আমি মনে করি।”
এভাবে কৃত্রিমভাবে তৈরি করা জনপ্রিয়তাকে শিক্ষার্থীরা ইতিবাচকভাবে নিচ্ছে না। সাধারণ শিক্ষার্থীরা চান, তাদের মধ্য থেকেই যোগ্য প্রার্থী নির্বাচিত হোক— যে প্রার্থী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মিশবে, একজন শিক্ষকসুলভ ভূমিকা পালন করবে। কিন্তু বর্তমানে আমরা দেখছি কিছু প্রার্থী বিশাল দল নিয়ে শোডাউন দিচ্ছে, ক্যাম্পাসের হলে হলে ঘুরছে। এসব কর্মকাণ্ডকে সাধারণ শিক্ষার্থীরা কোনোভাবেই ভালোভাবে গ্রহণ করছে না— দাবি ওই শিক্ষার্থীর।
একনজরে ডাকসু নির্বাচন
এবার ডাকসুর ভিপি পদে ৪৫ জন, জিএস পদে ১৯ জন ও এজিএস পদে ২৫ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। সম্পাদকীয় পদগুলোর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন সম্পাদক পদে ১৭ জন, কমনরুম, রিডিংরুম ও ক্যাফেটেরিয়া সম্পাদক পদে ১১ জন, আন্তর্জাতিক সম্পাদক পদে ১৪ জন, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে ১৯ জন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক পদে ১২ জন, গবেষণা ও প্রকাশনা সম্পাদক পদে নয়জন, ক্রীড়া সম্পাদক পদে ১৩ জন, ছাত্র পরিবহন সম্পাদক পদে ১২ জন, সমাজসেবা সম্পাদক পদে ১৭ জন, স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সম্পাদক পদে ১৫ জন, মানবাধিকার ও আইন সম্পাদক পদে ১১ জন এবং ক্যারিয়ার উন্নয়ন সম্পাদক পদে ১৫ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এছাড়া, ১৩টি সদস্য পদে ২১৭ জন প্রার্থী হয়েছেন।
চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা অনুযায়ী, যে ৬২ জন ছাত্রী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন তাদের মধ্যে ভিপি পদে পাঁচজন, জিএস পদে একজন ও এজিএস পদে রয়েছেন চারজন। এছাড়া, মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন সম্পাদক পদে দুজন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক পদে একজন, কমনরুম, রিডিংরুম ও ক্যাফেটেরিয়া সম্পাদক পদে নয়জন, স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সম্পাদক পদে তিনজন, ক্যারিয়ার উন্নয়ন সম্পাদক পদে দুজন, সমাজসেবা সম্পাদক পদে একজন, ক্রীড়া সম্পাদক পদে একজন, গবেষণা ও প্রকাশনা সম্পাদক পদে তিনজন, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পদে দুজন, মানবাধিকার ও আইন সম্পাদক পদে তিনজন এবং সদস্য পদে ২৫ জন ছাত্রী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রে তিন স্তরের নিরাপত্তা থাকবে। প্রথম স্তরে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনসিসি ও প্রক্টরিয়াল টিমের সদস্যরা, দ্বিতীয় স্তরে পুলিশ এবং তৃতীয় স্তরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাতটি প্রবেশমুখে ‘স্ট্রাইকিং ফোর্স’ হিসেবে অবস্থান নেবে সেনাবাহিনী।
এ সংক্রান্ত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানায়, নির্বাচনের সময় রিটার্নিং কর্মকর্তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী পুলিশ বাহিনী দায়িত্ব পালন করবে। প্রয়োজনে সেনাবাহিনী ক্যাম্পাসে প্রবেশ করবে। ভোট শেষে ফলাফল প্রকাশ না হওয়া পর্যন্ত ভোটকেন্দ্র সেনাসদস্যরা ঘিরে রাখবেন। ভোট গণনার সময় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ছাড়া অন্য কারও প্রবেশের সুযোগ থাকবে না।
আবাসিক হলগুলোর বিষয়ে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, নির্বাচনের সাত দিন আগে থেকে আবাসিক হলে কোনো বহিরাগত থাকতে পারবে না। নিয়মিত টহল পরিচালনার মাধ্যমে এ ব্যবস্থা কার্যকর করা হবে।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, নির্বাচনের আগের দিন (৮ সেপ্টেম্বর) ও নির্বাচনের দিন (৯ সেপ্টেম্বর) মেট্রোরেলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্টেশন বন্ধ থাকবে। নির্বাচনের দিন বৈধ শিক্ষার্থী, অনুমোদিত সাংবাদিক ও নির্বাচন পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা ছাড়া অন্য কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করতে পারবে না।