নিজের জীবনের মুল্য বুঝুন,ঘরে থাকুন: এএসপি আবদুল হালিম
দীপের বাবা কালাম সাহেব স্থানীয় হাই স্কুলের একজন প্রসিদ্ধ ইংরেজি শিক্ষক তার স্ত্রীও একটি কিন্ডারগার্ডেন এর শিক্ষিকা। দুজনের আয়ে ভালই চলছিল মধ্যবিত্ত কালাম সাহেবের সংসার। এক এক করে প্রতিটি ছেলে মেয়েকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করান কালাম সাহেব।
৪/৫ টি ছেলে মেয়ে যখন একই সময় পড়াশুনা করে তখন খরচের চাপ সহ্য করা অনেকের জন্যই দুরুহ হয়ে যায়। কালাম সাহেবের ক্ষেত্রেও এর ব্যাতিক্রম ঘটেনি। নিজের সবটুকু সঞ্চয় এবং বাবার সব সম্পত্তি বিক্রি শেষ। অবশিষ্ট বলতে কিছুই নেই তার।
এদিকে তুখোড় মেধাবি দীপ কেবল মাত্র কলেজে ভর্তি হয়েছে। উঠতি বয়সের আবেগ নিয়ন্ত্রন করতে পারেনি দীপ, প্রেমে পড়েছে সমবয়সি একটা মেয়ের। ফলাফল যা হবার তাই হল, উচ্চ মাধ্যমিকের রেজাল্ট খারাপ। পড়াশুনা কম করার জন্য দেশের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হতে পারলো না দীপ। এদিকে মেয়েটির সাথে এই সময় সম্পর্ক টিকিয়ে রাখাও তার জন্য দুরুহ হয়ে পরেছে।
তারুন্যের উছ্বাস থেকে জন্ম নেয়া প্রেম যে তার জীবনে কত বড় ক্ষতি ডেকে এনেছে, তা সে যখন বুঝতে পেরেছে তখন অনেক সময় পেরিয়ে গেছে। এবার পুরাই ইউটার্ন, আবার পড়াশুনা শুরু। বিদেশি একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কলারশিপ পেয়েছে সে। আগেই বলেছি চিন্তা চেতনায় সে তার সমসাময়িক বন্ধুদের চেয়ে অনেক এগিয়ে এবং আলাদা।
দীপ স্কলারশিপ পেয়েছে ঠিকই; কিন্তু একটা নুন্যতম খরচ তো জোগাতে হবে। কালাম সাহেবের কপালে চিন্তার ছাপ পরে গেছে। এত টাকা সে কোথায় পাবে? সম্ভব্য সকল জায়গা থেকে ধারে টাকা আনা আগেই শেষ হয়ে গেছে। কি করবে ভেবে পাচ্ছে না।
মেঝ এবং সেঝ মেয়ের স্কলারশিপের টাকা, বড় ছেলের টিউশানির জমানো টাকা, মায়ের টুকটাক গয়না বেচা টাকা দিয়ে দীপ কে প্লেনে উঠিয়ে দেয়া হল। দীপের বাবা কালাম সাহেব, আদরের ছেলের প্রস্থান আসলে মেনে নিতে পারেননি। ছেলের বিদেশ যাওয়ার শোকে ৬ মাসের মাথায় সে অসুস্থ হয় এবং ৮ মাসের মাথায় মারা যায়। তার ২ বছর পর দীপের মা ও মারা যায়। বিদেশে পড়াশুনার জন্য কলিজার টুকরা মা বাবা কাউকে দেখতে পায়নি দীপ।
পরাশুনা শেষে দেশে ফিরে এসে চাকরির ইন্টারভিউ দেয় সে, একে একে ৪/৫ টি বেসরকারি ব্যাংকে উচ্চ বেতনে চাকরি হয় তার। শেষমেশ একটি বেসরকারি ব্যাংকে থিতু হয় সে। বিয়ে করে মৌসুমিকে, সর্বগুনে গুণান্বিতা একটি মেয়ে মৌসুমি।
দীপ আদর করে তাকে মৌ বলে ডাকে আর মৌ তার রুপ, গুন দিয়ে আচ্ছন্ন করে রাখে পরিবারকে। বিয়ের একবছরের মাথায় একটা ছেলে হয় দীপের। ছেলের নাম রাখে দিব্য। দীপের পৃথিবী এখন তার ছেলে। ছোট বেলায় ক্রিকেটের প্রতি অসম্ভব ঝোক থাকায় ছেলেকে ক্রিকেটার বানানোর স্বপ্ন দেখে দীপ।
শুধু অফিস টাইম বাদ দিয়ে, ছেলেকে এক মুহুর্তের জন্য চোখের আড়াল করে না দীপ। বাবা ছেলের বন্ধুত্ব যেন সবাইকে অবাক করে দেয়। একই রঙ এর জামা, প্যান্ট, জুতা পড়ে তারা, এরই মধ্যে বাপ-বেটা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ব্যাপক পরিচিত হয়ে উঠেছে।
দিব্যর বয়স এখন ৭/৮ বছর। এরমধ্যে মৌ এর কোল আলো করে আসল তাদের রাজকন্যা দিপ্র। এ সুখের যেন কোন সীমানা নেই। ভালই যাচ্ছিল তাদের সংসার। এরই মধ্যে হঠাত দীপ অসুস্থ হয়ে পড়লো রাত তখন ২ টা।
প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট হচ্ছে দীপের, কি করবে ভেবে পাচ্ছে না মৌ। দীপের বড় ভাইকে ফোন দিল সে, সব শুনে বড় ভাই বুঝল আর যাই হোক বিষয়টা আর কোন সাধারন পর্যায়ে নেই। দ্রুত ঢাকার যে সকল কোভিড ১৯ (করোনা) হাসপাতাল রয়েছে সেগুলাতে ফোন করল। দেড় ঘন্টা পরে এম্বুলেন্স এসে হাজির সাথে মহাকাশচারীর পোশাক পরিহিত চারজন সদস্য।
ছোট করে ব্যাগ গুছিয়ে নেয় দীপ। দুই ছেলে ঘুমুচ্ছে পাশের রুমে। শেষ বারের মত ছেলেদের কপালে চুমু খেতে গিয়েও সরে আসে সে, পাছে ছেলেরা আক্রান্ত হয়ে যায়। নিজে গিয়ে ওঠে এম্বুলেন্সে হাতে সেই ছোট ব্যাগটি, ছল ছল চোখে দূরে দাঁড়িয়ে বড় ভাই আসলাম এবং দিপের স্ত্রী মৌ।
বড় ভাই আসলাম ৫ ভাই বোনের মধ্যে সবার বড় হওয়ায় দায়িত্বটা একটু বেশি, ছোটবেলা থেকেই ছোট ভাইটির ভাল মন্দ সবকিছুর সঞ্চালক সে। দীপের হাসপাতাল যাবার দৃশ্যটা তাই কোন ভাবেই সে মেনে নিতে পারছে না।হাত পা যেন অসাড় হয়ে গেছে তার। এম্বুলেন্সের পিছন পিছন হাসপাতালে গিয়ে পৌছায় আসলাম। ভাইকে ভর্তি করিয়ে বাকি রাতটুকু হাসপাতালের বারান্দায় কাটিয়ে দেয় সে। পন করে ভাই কে সুস্থ করে তবেই বাড়ি ফিরবে।
রাত বাড়তে থাকে,বাড়তে থাকে দীপের শ্বাসকষ্ট, সাথে পাতলা পায়খানা, গলা ব্যথা ও জ্বর। সকল উপসর্গ ই করোনার। ডাক্তার এসে তার স্যাম্পল নিয়ে যায় রিপোর্ট কাল আসবে, বড় ভাই আসলামের টেনশনের পারদ আরো উপরে উঠতে থাকে মিনিট-ঘন্টা-দিন কোনটিই যেন আর কাটছে না।
কখন রিপোর্ট আসবে, রিপোর্ট কি হবে? এদিকে আদরের ছোট ভাইয়ের অসুখের শোকে বিছানায় শয্যাশায়ী বোনেরা। সৃষ্টিকর্তার দরবারে প্রার্থনা চলছে অবিরত। এ যেন যমে মানুষে টানাটানি চলছে কার দিকে যাবে দীপ?
হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছে দীপ। প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট দেখে পাশের বিছানার রোগী বলল ছোটভাই অক্সিজেন মাস্ক টা মুখে লাগাও, একটু ভাল লাগবে। খুড়িয়ে খুড়িয়ে কোনমতে অক্সিজেন সিলিন্ডার টা কাছে নেয় দিপ। মুখে লাগিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নেয় সে, এবার কিছুটা ভাল লাগে তার।
হাসপাতালের অবস্থা খুবই করুন। চারপাশ শুধু নোংরা আর আবর্জনায় ভরা। ১০ জন রোগীর জন্য একটি মাত্র টয়লেট। যেখানে আছে একটি হাই কমোড কিন্তু হ্যান্ড সাওয়ার নেই, তাই সেটা ব্যবহারের অনুপযোগী। নাই কোন বেসিন ফলে যেখানে টয়লেট সেখানেই খাবার ধোয়া। একদিকে রোগীদের শ্বাসকষ্ট অপরদিকে ধুলা- বালি আর মশায় সয়লাব।
আবার রোগী ভর্তির পর কেউ সাহস করে কাছেও আসে না। সকাল বেলা একবার আসে মরা রোগী বের করতে এ যেন পোল্ট্রি ফার্ম মরা মুরগী নিয়ে সোজা ভাগারে ফেলে দেয়া। সারাদিনে আর কারো দেখা নাই। ডাক্তার আসল কি আসল না তা বোঝা যাচ্ছে না। আসলে সবাই একই পোশাক পরায় কে যে ডাক্তার আর কে যে ওয়ার্ড বয় তা চেনা মুশকিল হয়ে পরেছে।
পরের দিন দীপের শারীরিক অবস্থা আরো শংকটাপন্ন হয়ে যায় ডাক্তার বলে দ্রুত তাকে আই সি ইউ তে সিফট করতে হবে কিন্তু এ হাসপাতালে আই সি ইউ বেড খালি নাই। আরেক যুদ্ধ শুরু হয় আসলামের, যত পরিচিত জন ছিল ভাইয়ের জীবন বাচাতে সবাইকে ফোন করে সে। এদিকে পালস কমে যাচ্ছে দীপের, দ্রুত আই সি ইউ সাপোর্ট না দিলে বিপদের সমুহ সম্ভাবনা রয়েছে।
চোখের সামনে ভেসে উঠছে প্রিয় দুই সন্তানের মুখ। কি অসহায় সে চাহনি, বাবা না থাকলে কে দেখবে তাদের। কে পুরন করবে দিব্য-দিপ্র দের সকল ইচ্ছা। মৌ এমন কিছু করে না যে দীপের অবর্তমানে সংসার চালিয়ে বাচ্চাদের বড় করবে।
ভেবে ভেবে চারদিক আরো অন্ধকারে ছেয়ে যায় দীপের। অন্ধকারে হাতরিয়ে অক্সিজেন মাস্কটা আবার মুখে লাগায় সে। পালসটা আরো কমতে থাকে তার। মনোবল হারিয়ে ফেললেও সন্তানের কাছে ফেরার তীব্র আকংখা তার….
মুলকথা: নিজের জীবনের মুল্য বুঝুন। ঘরে থাকুন।
লেখক : মো: আবদুল হালিম
সহকারী পুলিশ কমিশনার (কাউনিয়া জোন), বি এম পি, বরিশাল