রাজবাড়ীতে ঔষধি উদ্ভিদের জিনব্যাংক
লাইফস্টাইলঃ রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার বহরপুরে ৪৩ একর জমির ওপর গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের একমাত্র ঔষধি উদ্ভিদের প্রাকৃতিক জিনব্যাংক। এটি শুধু বাংলাদেশেরই নয় ভারত উপমহাদেশের মধ্যেও একমাত্র বলে দাবি করেন জিনব্যাংকটির উদ্ভাবক ড. আব্দুল হাকিম। যিনি নিম হাকিম নামে দেশে-বিদেশে সমানভাবে পরিচিত।
এই জিনব্যাংকের ক্যাম্পাসে রয়েছে ৬৯৭টি প্রজাতির ঔষধিসহ ১ হাজার ২৬১ ধরনের ফলদ ও বনজ গাছ। আর সব মিলিয়ে এর সংখ্যা প্রায় ২০ থেকে ২২ লাখ। শুধু তাই নয় এখানে সংরক্ষণ করা হয়েছে দেশ থেকে হারিয়ে যাওয়া নাম না জানা অনেক গাছ।
ড. আব্দুল হাকিম দৈনিক সময়ের আলোকে বলেন, শুধু বাংলাদেশ থেকেই নয় পৃথিবী থেকেও বিলুপ্ত হওয়া এমন গাছও সংরক্ষণ করা হয়েছে এখানে। তার মধ্যে একটি হচ্ছে তালিপাম। এই গাছটির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ১০০ বছর বয়স হলে মূল ও ফল দেয়। এরপর গাছটি মারা যায়। শুধু তালিপামই নয় নীল আদা, ননি, রবিনসন বার্লিসহ পৃথিবীর অনেক বিলুপ্ত ও বিরল প্রজাতির ঔষধি উদ্ভিদও রয়েছে এখানে। আর এটি গড়তে তার শ্রম ও সাধনা করতে হয়েছে তিন যুগেরও বেশি।
এখানেই থেমে থাকেননি তিনি। প্রাকৃতিক ওষুধের উপরে একটি আন্তর্জাতিক বিশ^বিদ্যালয় করার স্বপ্নও দেখছেন তিনি। যেটি কি না পৃথিবীর এখনও কোথাও হয়নি। ড. নিম হাকিম বলেন, আপনারা যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন এটার নাম হচ্ছে শান্তিমিশন। আমার এই শান্তিমিশনের কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৮২ সালে।
প্রথমে শুরু করা হয় দুই একর ১৬ শতাংশ জমির ওপর। পরে আস্তে আস্তে নিজের কষ্টের অর্জিত অর্থ দিয়ে ৪৩ একর জায়গার ওপর গড়ে তুলি ঔষধ উদ্ভিদের বিশাল এই জিনব্যাংক। তিনি বলেন, এটা করার সময় আমার একটা চিন্তা ছিল।
ছোটকাল থেকেই আমি যে ঔষধি গাছগুলো চিনতাম এবং দেখতাম সেগুলো বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এই বিলুপ্ত হওয়ার কারণে বাংলাদেশে ইউনানী আয়ুর্বেদিক ও হোমিওপ্যাথিক কারাখানায় তারা ওষুধ তৈরি করছে সেই ওষুধ খেয়ে মানুষের তেমন কোনো কাজ হচ্ছে না। তারা যেসব ওষুধ তৈরি করছে এবং যে কাঁচামাল ভারত, চায়না, তুরস্ক, থাইল্যান্ড বা যেখান থেকেই আনছে সেগুলো কোথায়, কবে জন্ম নিয়েছে এর কার্যকারিতা সঠিক আছে কিনা তার কোনো ইতিহাস নেই।
এই ন্যাচারাল ওষুধের অধিকাংশ ব্যবহারকারী দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোক এবং তারা সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাদের কাছে নিরাপদ এবং ওষুধের কার্যকারিতা বলবদ আছে এ ধররের ওষুধ যদি পৌঁছানো যায় তাহলে তারাও উপকৃত হবে। ব্যবসাটাও হালাল হবে। সেই চিন্তা থেকেই আমি এখানে আস্তে আস্তে ঔষধ উদ্ভিদের জিনব্যাংক গড়ে তুলি। আমাদের বিশেষত্ব হচ্ছে এখানে কোনো কেমিক্যাল ফার্টিলাইজার ব্যবহার করা হয় না। এখানে শতভাগ অর্গানিক হচ্ছে এবং টোটাল ক্যাম্পাসটাই একটা ইকোলজিক্যাল ক্যাম্পাস।
ড. আব্দুল হাকিম বলেন, আমরা এখানে মা গাছ তৈরি করি। এখান থেকে বীজ কাটি, গ্রামের মহিলাদের প্রশিক্ষণ দেই। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মেডিসিনাল প্লান্টস অ্যান্ড হারবাল প্রোডাক্টস বিজনেস প্রমোশন কাউন্সিল থেকে এই প্রশিক্ষণার্থীদের মধ্যে কিছুটা আর্থিক সহায়তা দিয়ে থাকি এবং এগুলো দিয়েই আমরা আস্তে আস্তে সমগ্র বাংলাদেশেই ভেষজ ঔষধ উদ্ভিদের অর্গানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ এবং প্রাথমিক প্রক্রিয়াজাতকরণের কর্মকাÐ শুরু করেছি।
তিনি বলেন, আমরা শুধু এখানে এই উদ্ভিদ দিয়ে প্রসাধনী বা ফাংশনাল ফুড বা ওষুধ তৈরি করছি তা নয়। আমার স্বপ্ন আছে, যারা এই ওষুধের জন্য মানুষকে প্রেসক্রিপশন করবে তাদের জন্য ক্যাম্পাসের ভেতরেই আন্তর্জাতিক বিশ^বিদ্যালয় করার। যার নাম হবে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব ন্যাচারাল মেডিসিন। অর্থাৎ প্রাকৃতিক ওষুধের ওপরে একটা বিশ^বিদ্যালয়। যেটা পৃথিবীর কোথাও এখনও হয়নি।
ঠিক একই সঙ্গে ওই স্টুডেন্টরা যেখানে থাকবে তাদের গবেষণার সুবিধার্থে আমরা এখানে একটা আন্তর্জাতিক ভেষজ গবেষণা ও উন্নয়ন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত করব। আমরা ইতোমধ্যে এই বিশ^বিদ্যালয় এবং ভেষজ গবেষণাগার বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে কপি রাইটপ্রাপ্ত হয়েছি। খুব শিগগিরই এখানে কনস্ট্রাক্টশনের কাজ শুরু হবে। যেহেতু এখানে ইকোলজিক্যাল ক্যাম্পাস তাই ইকোলজিক্যাল ম্যাটারিয়াল আমরা অনুসন্ধান করছি এবং আমরা সেটা পেয়েও গেছি। আমরা আশা রাখি আগামী দুই বছরের মধ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ছাত্রছাত্রীরা এখানে আসবে। বিশ^বিদ্যালয় পর্যায়ে ন্যাচারাল মেডিসিনের ওপর তারা লেখাপড়া করবে। তারা এখানে আন্তর্জাতিক গবেষণাগারে গবেষণার সুযোগ পাবে।
তিনি বলেন, আমার জানা মতে শুধু বাংলাদেশই নয় ভারত উপমহাদেশেও এমন জিনব্যাংক নেই। এটা নিয়ে কেউ চিন্তাও করে না। মানুষ ধানের জিন, গমের জিনসহ নানা রকমের জিনব্যাংক বানাচ্ছে। কিন্তু মানুষের যেটা উপকারী, যেটা দিয়ে মানুষের ওষুধ হয়, যেটা দিয়ে মানুষের জীবন রক্ষা পায়, যেটা নিয়ে ব্যাপক গবেষণার সুযোগ আছে, যেটা নিয়ে দরিদ্র মানুষের ব্যাপক অথনৈতিক স্বার্থের সম্পর্ক রয়েছে সেই জিনিস নিয়ে কেউ কাজ করছে না।
এ সময় তিনি আরও নানা ধরনের ঔষধি গাছের গুণের কথা তুলে ধরেন। তার এই শান্তিমিশনে দেশের একমাত্র ইকো পÐও রয়েছে। যেখানে বিলুপ্তপ্রায় দেশি প্রাণিকুল অবাধে বিচরণ করে থাকে বলেও জানান উদ্ভিদপ্রেমী ড. নিম হাকিম।